Sunday, March 19, 2017

Andaman - The land of emerald blue sea and silvery sand

                অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সমুদ্র ভ্রমণের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেল আমাদের| চাকরিসুত্রে দিল্লী আসার পর থেকে শুধুই হিমালয় চলছিল, এ পাহাড়  থেকে ও পাহাড়| কিন্তু এবার আন্দামান যাওয়ার তোড়জোড় বেশ অনেকদিন আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছিলাম| জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীই আন্দামান ভ্রমণের সেরা সময়| অফিসে ছুটি নেওয়া থেকে টিকিট কাটা – সব নভেম্বর এর মধ্যেই সেরে ফেলেছিলাম|

     বেশ কয়েক বছর ধরেই সব বেড়াতে যাওয়ার যাবতীয় ঝক্কি আমাকেই পোহাতে হয়| প্ল্যানিং থেকে হোটেল বা গাড়ি বুকিং – সব দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে বাকি সকলে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে বেরিয়ে পড়েন| এবার আমার শর্ত ছিল বাকিদেরই সব দায়িত্ব নিতে হবে| কিন্তু বেরোনোর আগের দিন দেখলাম দু-চারটে হোটেলের নাম টুকে রাখা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই কেউ করতে পারেনি| হোটেল বুকিং করার ব্যাপারে একটা বাধা অবশ্য ছিল – ফেরি শেডিউল এর অনিশ্চয়তা| অতএব শুধুমাত্র ফ্লাইট টিকিট এবং আমারই বানানো একটি দৈনিক ভ্রমণ খসড়া হাতে নিয়ে রওনা হলাম সাগর পাড়ি দিতে|

৩০.১.২০১৭:                 কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট কাকডাকা ভোরে| অর্থাৎ জানলার পাশের সিটে বসে সূর্য আর ফ্লাইট এর আকাশে ওঠা একসাথেই দেখা যায়| ফ্লাইট থেকে সূর্যোদয় দেখা এক মজার অভিজ্ঞতা| দিগন্ত রেখার ওপরে বসে নিচে সুয্যিমামার ঘুম ভাঙ্গতে দেখা যায়| সাদা মেঘের সমুদ্রে তখন ছড়িয়ে পড়ছে আরো একটা নতুন দিনের নতুন আশার ঢেউ| মন গুনগুন করে ওঠে – “আজ ম্যায় উপর, আসমা নিচে” |

     বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি অথচ চোখের সামনে কেবলই মেঘের রাজ্য| অবশেষে এক সময় ডাঙার দেখা পাওয়া গেল| বিপুল জলরাশির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবুজে ঢাকা দ্বীপরাজি| এই সেই আন্দামান, ইতিহাসে যার উপস্থিতি অধিকাংশই কলঙ্কে মোড়া| দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্বাসনের দ্বীপ, কালাপানি নামের কালিমা ঘুচতে যার সময় লেগে গেছে অনেক বছর|

     আমাদের ফ্লাইট নামল সেই কালাপানির বুকে| একটা ছোট্ট এয়ারপোর্ট| ততোধিক ছোট একটা রানওয়ে| লাগেজ বেল্টের সামনে এবারও প্রতিক্ষা| চিরকাল দেখেছি কোনো এক অলৌকিক মন্ত্রবলে আমাদের ব্যাগ গুলোই আসে সবার শেষে ! সব যাত্রী যখন হোটেলে পৌঁছে গেল হয়ত, তখন হেলতে দুলতে তারা এলো| বেরিয়ে এসেই পেয়ে গেলাম গাড়ি| আমাদের কোনো হেটেলে বুকিং নেই, অগত্যা সারথিই ভরসা এখন| ছেলেটির নাম পুগাল, আদতে তামিল, কিন্তু আন্দামানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা| “আমি থাকতে আপনাদের কোনো চিন্তা নেই” – তার এই আশ্বাসবাণী অবলম্বন করে তার বাহনে চড়ে বসলাম| ছেলেটি যেন সরলতার প্রতিমূর্তি| অবশ্য আগামী কয়েকদিন আন্দামানে থাকতে থাকতে বুঝেছি, এটা বোধহয় এই জায়গাটারই গুণ| ক্রাইম-ট্রাইম এখানে হয়না বললেই চলে| এবং হোটেল বা অন্যান্য সর্বত্র স্থানীয় লোকজন আমাদের যতটা বিশ্বাস করেছে, আমরা হয়ত নিজেদেরও ততটা করতে পারি না|


     পোর্ট ব্লেয়ার আমার দেখা প্রথম জায়গা যেখানে এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহরের দুরত্ব খুবই কম| এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে একটি হোটেলে এনে দাঁড় করলো পুগাল| কোস্টাল ব্রিজ| কোলাহল থেকে দুরে, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে ভীষণ ঘরোয়া এই হোটেলটি দেখেই মনে ধরে গেল| ব্যবস্থাপনারও কোনো ত্রুটি নেই| চেক-ইন করেই পুগালের সাথে ঠিক করে নেওয়া হল আমাদের ভ্রমণের প্রাথমিক খসড়া| সে নিজেই দায়িত্ব তুলে নিল ফেরি টিকিট এবং প্রয়োজনীয় পারমিট এর| অতএব আমরা এবার নিশ্চিন্ত|


     বেড়াতে এসে হোটেল বন্দী হয়ে থাকা আমার ঘোর অপছন্দের| তাই স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা ঘুরে দেখতে| আমাদের হোটেলটা একটু চড়াই অঞ্চলে| বেরিয়ে সামান্য নিচের দিকে হাঁটা দিতেই সমুদ্রের নীল ধরা দিল আমাদের চোখে| রাস্তাঘাট ঝকঝকে, তকতকে| ধুলো নেইই, তাই উড়ছেও না| আকাশও তাই যেন একটু বেশিই নীল এখানে| তখনও বুঝিনি আরো কত অজস্র রকমের নীল আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে এই গোটা যাত্রাপথে| হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে এসে পৌছলাম| কাছেই আবেরডিন জেটি| কিছুক্ষণ জাহাজের আনাগোনা দেখে আর নীলচে-সবুজ জলের মুগ্ধতা নিয়ে ফেরার উদ্যোগ নিলাম| মাথার ওপর সুয্যিদেব ক্রমশই প্রখর থেকে প্রখরতর হয়ে চলেছেন| তাছাড়া দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেই ঘুরতে বেরোনোর প্ল্যান|


     যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে পুগাল এসে গেল| আন্দামান এসে মাছ খাব না, তাও কি হয়? হোটেলের কাছেই “আনন্দ” রেস্তোঁরায় ফিশ সিজলার সহযোগে লাঞ্চ সেরে নিলাম| সদ্য ফেসবুকে সরিৎ চ্যাটার্জীবাবুর লেখা “কালাপানি” ধারাবাহিকে এই রেস্তোঁরার উল্লেখ দেখে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেছিল| খাওয়ার পর্ব সেরে আমরা রওনা দিলাম সেলুলার জেলের উদ্দেশ্যে|


     এই সেই সেলুলার জেল| কালাপানির কালান্তক ইতিহাসের প্রতিমূর্তি, রক্ত আর নৃশংসতার, অত্যাচার আর যন্ত্রণার সাক্ষী| সিপাহী বিদ্রোহের পর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্যে ব্রিটিশদের তৈরী “পেনাল সেটলমেন্ট”| এ যেন এক মূর্তিমান নিষ্ঠুরতা| সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া সাতটি বাহু (বর্তমানে তিনটি উপস্থিত), প্রতিটি তিনতলা, সর্বমোট ৬৯৩ টি কারাকক্ষ| বাহুগুলির নির্মান আবার এমনই যে একটির সম্মুখভাগ অপরটির পশ্চাতভাগের মুখোমুখি, যাতে বন্দীরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ না করতে পারে| বন্দীদের জন্যে বরাদ্দ এক একটি ছোট ছোট খুপরি, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ঘড়ির কাঁটার শৃঙ্খলে| এর লম্বা টানা বারান্দা, লোহার দরজা, ফাঁসির দড়ি – সব কিছুই আজ ব্যক্ত করে চলেছে সেই কষ্টের ইতিহাস, চোখের জল এখানে বাঁধ মানে না| আজও প্রতিটা ইঁট – কড়িকাঠে সোচ্চার হয়ে ওঠে সওয়া-শো বছরের জমানো হাহাকার|

 বুকের মধ্যে জমে ওঠা ভারি বোঝাটা হালকা হয়ে ওঠে জেলের ছাত থেকে সমুদ্র দেখে| গাঢ় নীল জল, কোনো কোনো দিকে ডাঙ্গা দেখা যাচ্ছে- ঘন সবুজে ঢাকা| এই অপরূপ রুপশোভা কতদিন ঢেকে ছিল অত্যচারের অন্তরালে| কষ্ট গুলোতে লাগাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম এই রাষ্ট্রীয় স্মারক থেকে| বোঝাটা আরো হালকা হল করবিন’স কোভ বীচে গিয়ে| ছোট্ট বীচ, এবং ধার দিয়ে সারি সারি নারকেল গাছ| ঢেউ এর মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে ছুটে চলা জেট-স্কি  দেখেই রক্তে এডভেঞ্চারের নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো| বাকিরা যদিও প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল, কিন্তু আমি তো যাবই!




     





ওখান থেকেই আবার ফিরে এলাম সেলুলার জেলে, লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে| আলোর ব্যবহার তেমন আকর্ষক না হলেও জেলের প্রাচীন ইঁট-পাথর আর প্রাচীনতর অশ্বত্থ গাছের কথোপকথনের মাধ্যমে সব অত্যাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ চোখে জল এনে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট|




     আজকের মত ঘোরাঘুরি এখানেই শেষ| ফিরে এলাম আমাদের হোটেলে|


৩১.১.২০১৭:                 আন্দামানে এলে বাঙালিদের পরবাস বলে মনে হওয়া সম্ভব নয়| যেমন বাঙালি পর্যটকদের ভিড়, তেমনি প্রচুর বাঙালিদের বসবাস| আমাদের হোটেলের রিসেপশন স্টাফও বাঙালি – শ্যামলদা| এছাড়া এক বাঙালি প্রবীন দম্পতিও এসে উঠেছেন এই হোটেলে| সকালে বেরোনোর আগে বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব, বাইরে এসে মঙ্গলবারে নিরামিষ খাওয়ার বিড়ম্বনা, আগামীকাল সরস্বতী পুজো নিয়ে জল্পনা-কল্পনা - সবই চলল খানিক| পুগাল যথাসময়ে এসে গেছে| আজ আমাদের গন্তব্য রস আর নর্থ বে আইল্যান্ড| বোটের (এখানে যদিও ফেরি বলে) টিকিট এর ব্যবস্থা পুগাল করে রেখেছে কথামত| বোটের নাম মুসাফির| আজ এই বোটে উঠে সেই যে লাইফ জ্যাকেট পরার অশান্তি শুরু হল, সেটা চলেছিল বাকি পুরো ট্রিপে, শেষ দিন পর্যন্ত| একে পরে না যায় ঘাড় ঘোরানো, না যায় সাবলীল ভাবে বসা| লাইফ জ্যাকেট যেন আমার গলায় মরণ ফাঁদ!




     রস আইল্যান্ড আবেরডিন জেটি থেকেই দেখতে পাওয়া যায়| পৌঁছে দেখলাম গোটা দ্বীপ জুড়েই নারকেল গাছের আধিক্য| এটি একটি ছোট দ্বীপ| এক সময় এখানেই কারাগার তৈরির পরিকল্পনা হয়, পরে এটিই হয়ে ওঠে প্রাচ্যের প্যারিস| এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত| ব্রিটিশ, জাপানী -  সবাই এটিকে দখল করতে চেয়েছে, এখানেই প্রথম উত্তোলিত হয়েছে স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা, নেতাজীর হাত ধরে| এখন সেই যুগের কিছু ভগ্নাবশেষ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই| সত্যি কি নেই কিছু? এর হাওয়া, নিরলস ভেঙ্গে চলা সমুদ্রের ঢেউ তো কত গল্প শোনায়, যারা শুনতে পায়, তারা পায়| সেই গল্পের আশায় হাঁটা লাগালাম| সময় বরাদ্দ আছে দেড় ঘন্টা, তার মধ্যে যতটা ঘুরে নেওয়া যায়| হাঁটছি, দেখছি, মাঝে মাঝে মুগ্ধতা বন্দী হয়ে উঠছে মুঠোফোনে| কয়েকটা হরিণ আশ্চর্যজনক নির্ভিক ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করে চলেছে সব পর্যটকদের গা ঘেঁষে| দরকার মত মডেল হয়ে পোজও দিচ্ছে বেশ|





     





এখান থেকে পাড়ি দিলাম নর্থ বে| স্কুবা ডাইভিং সকালেই বুক করা নেওয়া হয়েছে এখানের জন্যে, পোর্ট ব্লেয়ার থেকেই| “জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা” সিনেমাটির অনেকগুলো অনুপ্রেরণার মধ্যে এটা অন্যতম| “মুঝে আফশোষ করনা নেহি আতা” আর “করনা ভি নেহি চাহিয়ে” – ওই সিনেমার-ই এই দুই সংলাপ মনে এত দাগ কেটেছিল যে এখনো জীবনের সব ক্ষেত্রে এই জীবনদর্শন বজায় রাখার চেষ্টা করি| তাই, ছোট থেকেই জলে চূড়ান্ত ভীতি থাকা সত্বেও আন্দামানে এসে স্কুবা না করার আফশোষ যাতে বয়ে না বেড়াতে হয়, এটা আমি করবই| ওখানে পৌছে ধরাচূড়া পরে জলে নামতেই দেখলাম ভয়-টয় সব কোন ফুসমন্তর বলে উধাও| এখানে স্কুবা ইন্সট্রাকটরও বাঙালি ছেলে| চশমা পরে জলের নিচে তাকাতেই মনটা এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে গেল| ব্রীদিং পাইপ দিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া অভ্যেস করে জলের নিচে নেমে পড়া হল| এক অনাবিল প্রশান্তির জায়গা সে| কোনো শব্দই কর্ণগোচর হয়না, এবং এই প্রগাঢ় নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন আমি একা – এক অন্য অচেনা জগতে| যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির প্রবাল| একের পর এক রং-বেরঙের মাছের ঝাঁক ছুটে আসছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে, অনুভব করতে পারছি তাদের আলতো দংশন| আমি যেন এই অলীক রূপকথার জগতে জলপরী| এ যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জায়গা, নিজের সাথে একাত্ম হওয়ার জায়গা| সারা জীবনের জন্যে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হল এক বিপুল ঐশ্বর্য্যের সম্ভারে|





     জল থেকে উঠে লাঞ্চ সেরে হাঁটা দিলাম লাইট হাউসের দিকে| এ আমাদের সবার চেনা, ভারতীয় ২০ টাকার নোটে যে লাইট হাউসটি দেখা যায়, এটা সেটাই| বোটে আসার সময়েই দেখেছি একরাশ নারকেল গাছের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লাল-সাদা বাতিঘর| কিছুটা চড়াই ভেঙ্গে বাতিঘরের সামনে পৌঁছনো তো গেল, কিন্তু ওপরে ওঠার অনুমতি মিলল না| অগত্যা উল্টো পথে ফিরে চললাম|




ফেরার পথে আবার আর এক প্রস্থ জলের ঝাপটা খেতে খেতে (আসার পথেও হয়েছিল) এলাম| কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর গেলাম ফনিক্স বে জেটি, এখান থেকে আমরা আবার যাব রস আইল্যান্ড, লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে| সব আন্দামান ভ্রমণার্থীদের জন্যে আমার অনুরোধ, এটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না| বেশির ভাগ ট্যুর অর্গানাইজারদের ভ্রমণসূচীতে এটি থাকে না| কিন্তু এটি আমার দেখা সেরা আলোক-ধ্বনি প্রদর্শনী| দ্বীপের ইতিহাস অত্যন্ত সুচারুতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে| সাথে বাড়তি পাওনা গুলজার সাহেবের লেখণী আর শাবানা আজমীর অনন্য বাচনভঙ্গি| দুধনাথ তেওয়ারীর বিশ্বাসঘাতকতা, গ্রেট আন্দামানিজদের বিদ্রোহ, দ্বীপের প্রাচুর্য্যের দিন, সেখান থেকে গরিমা অবলুপ্তি - সব সুদক্ষ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই উপস্থাপনাটিতে| কখন যে নিজেই হারিয়ে যাই সেই দেড়শ বছর পেছনে, কখন যে সংগ্রামের আগুন আমার বুকের ভেতরেও জ্বলে ওঠে, কখন যে সব বীর শহীদদের আত্মত্যাগের মহানতা চোখ ঝাপসা করে দেয়! আর এই সব কিছুর সাক্ষী থেকে যায় আকাশের একফালি চাঁদ, তার সঙ্গিনী দুই উজ্জ্বল তারাদের নিয়ে|





১.২.২০১৭:                বেড়াতে এলেই দেখেছি খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে যায়| আর এখানে সারাদিন বেশ গরম থাকলেও শেষ রাতে বেশ হালকা শীতের অনুভূতি হচ্ছে| আজ প্ল্যান মাফিক আমরা যাব মহাত্মা গান্ধী মেরিন ন্যাশনাল পার্ক| বেশ অনেকগুলি দ্বীপের ফ্লোরা আর ফনা-র সংরক্ষণের জন্যে এই পার্কটি তৈরী| মূলত: দুটি দ্বীপে পর্যটকদের গতিবিধি সীমিত : জলি বয় (নভেম্বর – এপ্রিল) আর রেড স্কিন (মে – অক্টোবর)| আয়তনে রেড স্কিন অনেকটাই বড় জলি বয়-এর থেকে| কিন্তু জলি বয় অন্যান্য দ্বীপ গুলোর থেকে অনেকটা দুরে, যেখানে জলের গভীরতা অপেক্ষাকৃত বেশি| তাই বর্ষাপ্রবন সময় সেখানে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি থাকে না| ও‍‍‌য়ান্ডুর বীচ এর কাছে একটি জেটি থেকে বোট ছাড়ে| যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা| বোটে উঠেই আবার সেই লাইফ জ্যাকেট পরার জ্বালাতন| তবে যাওয়ার পথটা খুব সুন্দর| দুদিকে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে মোড়া দ্বীপেদের সঙ্গী করে সুনীল জলে সাদা ফেনা তুলে এগিয়ে চলেছে আমাদের বোট| অবন ঠাকুরের কাটুম কুটুমের সাথে পরিচয় আমার সেই ছোট্টবেলায়, বাবার হাত ধরে| শুধু এটাই নয়, ছোট থেকে আমার যা কিছু বই পড়া, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে, সবটাই বাবার জন্যে| তো সেই কাটুম কুটুম মনের একটা বিরাট আগ্রহের জায়গা জুড়ে ছিল ছোট থেকেই| এখনো দেখলাম সেই উৎসাহে কোনো খামতি নেই| যখনি কোনো দ্বীপের ধারে আসছে বোট, পাড়ের গাছ গাছালির গুঁড়ি দেখে মন কল্পনা করে নিচ্ছে বিভিন্ন পরিচিত আকৃতি| এদের মধ্যে যেটা সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল, সেটা হল – হাঁটু ভাঁজ করে জলে ডুবিয়ে রাখা কোনো যুবতীর দুধসাদা পদযুগল! কি নিখুঁত সেই আকৃতি| এই ছেলেমানুষীগুলো আমার বড় প্রিয়, মেঘ দেখেও এমন রূপকথা রচনা করি আমি| এই কল্পনার রূপকথাই আমার জগৎ, এই পাগলামি মাখা ভালো লাগা গুলোই আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন, আমার একাকীত্মের সঙ্গী|




     জলি বয় আইল্যান্ডটি যেন নীলবসনা সুন্দরীর কপালে একটুকরো সবুজ টিপ| এখানে কোনো স্থায়ী জেটি নেই| বোট এসে দাঁড়ায় একটি রবার জেটির সামনে, সেখান থেকে নৌকো করে দ্বীপে পৌঁছতে হয়| যাওয়ার পথে একটি গ্লাস বটম বোট রাইড করানো হয়, কোনো অতিরিক্ত শুল্ক ছাড়াই| সেটা নিতান্তই একটা ট্রেলার মাত্র| এর পর আলাদা করে ৪০-৪৫ মিনিটের আর একটা রাইড করা যায়, মোট ৩ টি কোরাল রীফ ঘুরিয়ে দেখানো হয়| কত বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল যে দেখলাম! কলিফ্লাওয়ার, মাশরুম, বোল্ডার – যেমন বিচিত্র তাদের নাম, তেমনই বিপুল তাদের বৈচিত্র| এর সাথে নানারকম মাছ তো আছেই| নানা রঙের জেলি ফিশ, মুক্ত-ঝিনুক, সমুদ্রশসা, সী এনিমনে লুকিয়ে থাকা ক্লাউন ফিশ- সব মিলিয়ে এ এক স্বপ্নের দেশ|





     এখানেও সমুদ্রের রং দেখে দুচোখ জুড়িয়ে যায়| নীল ও সবুজের যে কি অপূর্ব মিশ্রণ| চোখের সামনে যেন কোনো সম্মোহনের মায়াজাল বিছিয়ে দিয়েছে এক অদৃশ্য জাদুকর| ফেরার পথে তখন ভাঁটা চলছে| আসার পথে দেখা সেই যুবতীর পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এখন| ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে গেলাম ও‍‍‌য়ান্ডুর বীচে| সুয্যিমামা তখন দিনের পাট মিটিয়ে ছুটি নিতে উদ্যোগী| যাওয়ার বেলায় ঝুলিতে বেঁচে থাকা সব আবীর যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের গায়ে| লাল, কমলা, গোলাপী - সব| নাকি বেলাশেষের বিদায়ী চুম্বনে প্রেমিকা আকাশ রাঙিয়ে উঠছে লজ্জায়? বীচটি বেশ কম জনবহুল| তাই নিজের মত করে প্রতিটা মুহূর্ত বাঁচার সুযোগও অনেক বেশি| এখানে ওখানে পড়ে আছে মৃত প্রবাল| সমুদ্রতটে ছড়ানো রং বেরঙের ঝিনুক, শামুক, আরো কত কি! সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালেই মনটা কি ভীষণ উদাস হয়ে যায়! সামনে এক অসীম, বিশাল শুন্যতা আর তার মাঝে আমি যেন একা| এই পৃথিবীতে এটাই যেন চিরন্তন সত্য - একাকীত্ম|

 নিরলসে ভেঙ্গে চলা ঢেউ দেখতে দেখতে হেঁটে যেতে পারি আমি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত| সবাই তখন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, মুহূর্ত গুলোকে বন্দী করতে| আমি শুধু সেগুলোকে বেঁচে নিই, প্রাণ ভরে| পান করি অমৃতসুধা| সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারি আমি| এ যেন নিজের সবচেয়ে ভালবাসার মানুষটার মুখোমুখি বসে থাকা, চুপচাপ, শুধু চাহনিই কথা বলে যায়| ক্লান্ত হলে তার কাঁধে মাথা রেখে সব দু:খ ভুলে যাওয়া| আর লেখা হয়ে যায় কত অপ্রকাশিত প্রেমের কবিতা|













২.২.২০১৭:                আন্দামানের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি ভিন্ন মত শোনা যায়| পবনপুত্র হনুমানের নাম হন্ডুমান বা অন্ডুমান থেকেই নাকি আন্দামান নাম| কারো কারো মতে আন্দামান নামের অর্থ ভগবানের দেশ, আবার কেউ বলেন এ নাকি সোনার দেশ| তো নামের মানে যাই হোক, ক্রমেই আন্দামানের প্রেমে পড়ে চলেছি আমি| কি যেন একটা ম্যাজিক আছে এই জায়গাটায়| সবকিছুই যেন কেমন একটু বেশি ভালো লাগে| এমনকি সারাদিনের প্রখর রোদেও কষ্ট বোধ হয় না| বরং একটুখানি শীতল হাওয়ার স্পর্শেই যেন মন খুশীতে ভরে ওঠে| আজ আমাদের হ্যাভলক যাওয়া| আন্দামানের সবথেকে আলোচ্য ও সর্বাধিক জনপ্রিয় জায়গা|  এখানকার রাধানগর বীচ বিশ্বের সেরা দশটি সমুদ্রসৈকতের অন্যতম| পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সরকারী ফেরি ছাড়াও কয়েকটি প্রাইভেট সংস্থার বিলাসবহুল ফেরিও চলে| Makruzz এদের মধ্যে অন্যতম| আমাদের টিকিট এতেই| এখানেই অমৃতা, আমার ইস্কুলতুতো বোনের সঙ্গে দেখা| কি মিষ্টি ওর কন্যাটি| যদিও জ্বরে ভুগে বেচারী ভালো করে ঘুরতে পারছে না| কারোর কারোর একটু সী-সিকনেস হল দেখলাম এই জাহাজে| আগেই গুগল-এ রিভিউ দেখেছিলাম যে অনেকেরই এই সমস্যা হয় আর তাই নিয়ে নিজেই খুব চিন্তিত ছিলাম| তবে আমার কোনো অসুবিধা হল না| দেড় ঘন্টার জায়গায় পৌঁছতে প্রায় দু’ঘন্টা সময় লেগে গেল| হ্যাভলক জেটিতে পুগাল এর বন্ধু কান্নান-এর গাড়ি নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছে| ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এখানকার দায়িত্বও পুগাল নিয়েছে| তার বন্ধু গাড়ি ও হোটেল ঠিক করে রেখেছে| হোটেল কেমন হবে তা নিয়ে একটু ভাবনা ছিল, কিন্তু পৌঁছে খুব পছন্দ হয়ে গেল| এটি হ্যাভলক এর  বিজয়নগর বীচ (বীচ নং. ৫)-এ |
এখানেও হোটেল কর্মচারীরা সবাই বাঙালি| খাওয়া-দাওয়াও খুব ভালো, একদম ঘরোয়া রান্না| পুরো হোটেল পরিসরটাই খুব সুন্দর| অসংখ্য নারকেল আর সুপারি গাছ| আর সবথেকে ভালো ব্যাপারটা হল হোটেলের ঠিক পেছনেই বীচ| প্রাইভেট বীচই বলা যেতে পারে এটাকে| যেকোনো সময় এই বীচে অবারিত দ্বার|

আমরা সকালে স্নান-ট্নান সেরেই এসেছি| তাই এসেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করলাম বীচে এসে নারকেল গাছের ছাওয়ায় বসে| একটি বিদেশী দম্পতি এখানে একমাস থাকার প্ল্যান করে এসেছে! অবশ্য সুযোগ থাকলে আমারও তা করতে কোনো অসুবিধে নেই| জাহাজে আসতে আসতেই কিছুটা বুঝেছি, এখানে পৌঁছে আরো ভালো করে উপলব্ধি করলাম কেন হ্যাভলক নিয়ে ভ্রমণার্থীদের মধ্যে এত উন্মাদনা থাকে| কোনো এক সুদক্ষ চিত্রকর এখানকার সমুদ্রের ক্যানভাসে ইচ্ছেমত খেলা করেছে তার প্যালেট-এর নীল আর সবুজ রং নিয়ে| এই রং-এর কি নাম দেওয়া যায় আমি জানি না (যদিও নানা জায়গায় দেখেছি এটাকে Emareld Blue বলা হয়েছে, কিন্তু একে যেন কোনো নাম বেঁধে রাখা যায়না, এমনই তার বৈচিত্র্য)| খেলতে খেলতে কখন এক সময় রং ফুরিয়ে গেছে, তাই আর সমুদ্রতটে রং দিতে পারেননি শিল্পী| এখানে বালির রং তাই চোখে পরার মত সাদা| আর এই যুগ্ম বৈপরীত্য রচনা করেছে এক অতুলনীয় ছবি|

হ্যাঁ, পুরো জায়গাটা ছবির মতই সুন্দর| চোখের সামনে যেন কোনো এক বিশাল ক্যালেন্ডারের পাতা টাঙিয়ে দিয়েছে কেউ, অথবা এক সুবিশাল স্ক্রীনে ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ট্রাভেল শো চলছে! নাহলে বাস্তব কি এমন সুন্দর হতে পারে? এমন সৌন্দর্য্য ছেড়ে কেন কেউ বিদেশ ভ্রমণের কথা ভাবে?

সৈকতের নারকেল গাছ গুলোর সঙ্গে সমুদ্রের জলের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে| রোদে-ছায়ায়, আলো-আঁধারীতে তাদের গোপন প্রেমালাপ চলছে যুগ যুগ ধরে| সমুদ্র শীতল হাওয়ার মধ্য দিয়ে তার প্রেম নারকেল গাছকে নিবেদন করে, আর গাছ তার পাতার শনশন আওয়াজে তার সম্মতি জানায়| কখনো বা নিজেকে সমুদ্রের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে ঝুঁকে পড়ে তার বুকে| যখন ঢেউ এসে তাকে ছোঁয়, দিয়ে যায় তার চুম্বন| এই প্রেমকাহিনী দেখার জন্যে তো সারাদিন বসে থাকা যায়| কিন্তু এই কল্পনার জগত ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে হয় ক্ষিদের টানে| দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিকেল হলে আমরা গেলাম কালাপাত্থর বীচ| দিনের আলাদা আলাদা সময় সমুদ্র আলাদা আলাদা সাজে নিজেকে সাজায়| বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তখন তার পরনের বসনে অন্য রং| এখানে সমুদ্রতটের একদিকে প্রচুর মৃত প্রবাল| বিশাল বিশাল পাথরের মত ছড়িয়ে আছে| হয়ত সেই কারণেই বীচের নামকরণ| অন্য দিকে এদের আধিক্য তেমন নেই| বরং সাদা বালির বুকে মাঝে মাঝেই পড়ে আছে ভাঙ্গা গাছের গুঁড়ি| এদের দেখেও নানারকম কাটুম কুটুম কল্পনা করা যায়|


কোনোটা যেন বীর শহীদ, প্রাণ ত্যাগ করেও হাতের মশালটা উঁচু করে ধরে রেখেছে| কোনটা আবার অলস ভঙ্গিতে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে শুয়ে থাকা কোনো মানুষ| ভাবনার পরিধি তো কোনো গন্ডিতে বাঁধা যায়না, মনকে যত উদার করা যায়, ভাবনা ততটাই বিস্তৃত| তাই আমি যেমন ইচ্ছে ভাবি, আমার ভাবনার জগতটা তো শুধুই আমার| বাধা দেওয়ার জন্যে এখানে পর্যটকদের ভিড়ও নেই বললেই চলে| ভাবতে ভাবতেই হাঁটছি, সাদা ভেজা বালির বুকে সবুজ শ্যাওলা মাখা ছোট ছোট প্রবালগুলো রচনা করেছে এক নৈসর্গিক রূপ|


সারা আকাশ জুড়ে অস্তরাগের নেশা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য আজকের মত বিদায় নিল| আকাশের মেঘ গুলো পাঠশালার কচি কচি ছেলেগুলোর মত| হেডস্যার চলে যেতেই নিজেরা রং পেন্সিল নিয়ে দুষ্টুমি শুরু করে| আকাশে ছেলেমানুষী আঁকিবুঁকি কাটে| একসময় তারাও বিদায় নেয়| আকাশও ঘুমিয়ে পড়ে| আগামী দিনের আশা বুকে বাঁচিয়ে রেখে| আমরাও ফিরে আসি, চোখে অনেক মায়া, অনেক আলো মাখিয়ে|

৩.২.২০১৭:        সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো, বাইরে তখনও অন্ধকার| সামান্য আলো ফুটতেই বেরোলাম, পেছনের বীচটা থেকে সানরাইজ দেখা যায়| পৌঁছে দেখলাম ৩-৪ জন বিদেশী ছেলে মেয়ে ধ্যান করছে সমুদ্রতীরে বসে| ভোরের প্রথম আলোয়, মৃদুমন্দ বাতাসে, ঢেউদের আনাগোনায় মন সত্যিই শান্তিতে ভরে ওঠে এখানে| রাত্রির আঁধারের আঁচল ছিঁড়ে সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি যখন দেখা দেয়, আকাশ রাঙিয়ে ওঠা লজ্জায় তখন বরণ করে নেয় আর একটি নতুন সকাল|

     প্রাত:রাশ সেরে তড়িঘড়ি চলে এলাম জেটিতে| এখান থেকে এলিফ্যান্ট বীচ যাওয়ার টিকিটের জন্যে ফর্ম জমা করে অপেক্ষা করছি বোটের| আমাদের নাম যখন ডাকা হলো, টিকিট সংগ্রহ করে বোটের কাছে এসে দেখলাম আমাদের সহযাত্রী বেঙ্গালুরুর এক পরিবার, স্বামী-স্ত্রী আর দুই ছোট বাচ্চা| কনিষ্ঠটি তো সাংঘাতিক মিষ্টি! এখান থেকে এলিফ্যান্ট বীচে পৌঁছতে প্রায় আধঘন্টা মত সময় লাগে| এখানে একটি অসাধারণ কোরাল রীফ আছে, তাও আবার খুব কম গভীরতায়| অর্থাৎ, স্নর্কেলিং এর জন্যে আদর্শ এই বীচ| এখানেও বোট কর্তৃপক্ষ থেকে একটি কম সময়ের স্নর্কেলিং করানো হয়, টিকিটের দামের মধ্যেই এটা অন্তর্গত| তবে এতে স্বাদ মিটবে না| আলাদা করে আর একটি করা যায়, যেটাতে কোরাল রীফের বেশ আকর্ষনীয় অংশগুলো ঘুরিয়ে দেখানো হয়| একবার স্কুবা করে আমার সাহস এখন তুঙ্গে, আর রক্তে এডভেঞ্চারের নেশাও টগবগ করে ফুটছে| সুতরাং আবার নেমে পড়লাম জলে| এতে অবশ্য স্কুবার মত জলের নিচে ডুব দিতে হয়না| টিউবের সাহায্যে জলের ওপর ভেসে থেকে শুধু জলের নিচে দেখতে হয়| এখানেও বৈচিত্রের বিপুল সম্ভার| কতরকমের মাছ আর প্রবালই যে দেখলাম! অভিজ্ঞতার তুণীরে আরো একটি পালকের সংযোজন হল আজ আবার|

     এখানে সী-ওয়াকও হয়, কিন্তু সেদিন আর জায়গা ফাঁকা ছিল না| আমাদের ইচ্ছেও ছিল না তেমন আরো একবার জলে নামতে| ফিরতি বোটে ফিরে এলাম হ্যাভলক জেটিতে| সেখান থেকে রিসর্টে| ভেজা জামা কাপড় যদিও পাল্টে নিয়েছিলাম ওখানেই, কিন্তু সারা গায়ে তখনও  বালি ভর্তি| ভালো করে স্নান সেরে নিলাম এসেই| আজ বিকেলে যাব আমরা সেই বহু চর্চিত রাধানগর বীচে| বেশ উত্তজনায় ভরে আছে মন|

     রাধানগর বীচে পৌঁছে কিন্তু সেই উত্তেজনা বেশ খানিকটা দমে গেল| এত ভালো ভালো কথা শুনেছিলাম, এত ভালো ভালো রিভিউ পড়েছিলাম, এমনকি আমার বান্ধবী নিবেদিতাও তার আন্দামানের সামান্য কয়েকটি ভালো লাগার জিনিসের মধ্যে এটিকে রেখেছে, তাই হয়ত জায়গাটার থেকে প্রত্যাশা বেড়ে গেছিল অনেকটা| ততটা কিন্তু পেলাম না| হতে পারে সেটা অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে, বা অন্য কিছু – ঠিক বুঝিনি| কিন্তু কিসের যেন একটা অভাব অনুভূত হলো| এই কদিনে বাকি জায়গাগুলো যতটা আপন মনে হয়েছিল, এখানে যেন সেই আত্মিক টানটা নেই| হয়ত আমারই অক্ষমতা, কিন্তু এই জায়গাটাকে আমি নিজের করে নিতে পারলাম না| তা বলে এর সৌন্দর্য্যকে ছোট করার কিন্তু কোনো অবকাশ নেই| অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতটিতে সেই সাদা আর নীলের বৈপরীত্য| ভিড় এড়াতে আমি যথারীতি হাঁটা দিলাম প্রান্তের দিকে| সমুদ্রসৈকতে দূর থেকে দেখে মনে হয় ওই অর্ধচন্দ্রের ঠিক কোনাটাতে পৌঁছলেই সমুদ্রের মধ্যে চলে যাব| কিন্তু সেই কোণটা আর কখনই খুঁজে পাওয়া যায়না! যাওয়া, আসা সব সাড়া হয়ে গেল, সূর্য তাও এখনো বেশ উঁচুতে, কড়া চোখে অতি উচ্ছ্বাসী জনগনকে নজরে রাখছে| আমি বসলাম একটা ছাউনির তলায়| ঠিক এমন সময় চোখে পড়ল – একটা শিমুল গাছ| আগত বসন্তের বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার লাল বসনে| এই প্রথম রাধানগরকে ভালো লাগল, একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প যেন সেই ক্ষনিক মুহুর্তে লেখা হয়ে গেল গোপনে|

     ডাব খেতে খেতেই দেখি সুয্যি পাটে নামছেন| আবার সেই মায়ার খেলা, আবার সেই মায়াবী আলো, সেই রঙের নেশায় মাতোয়ারা চারপাশ| আরো একবার আচ্ছন্ন হয়ে ফিরে এলাম| কালকেই চলে যাব এখান থেকে| তাই ইচ্ছে করছে আরো একটু ছুঁয়ে থাকতে, আরো একটু গন্ধ মাখতে|

৪.২.২০১৭:        বেড়াতে এলে এই একটা মুশকিল, কোনদিন সকালে জমিয়ে ঘুম হয়না| রোজই বেরোনোর তাড়া| ঘুম চোখে উঠে তড়িঘড়ি স্নান, গোগ্রাসে ব্রেকফাস্ট সারা এবং কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া| আজ আমাদের গন্তব্য নীল আইল্যান্ড| এবং সাধন আবারও makruzz| নির্ধারিত সময়ের থেকে সে এলো একটু দেরিতেই| নীল এর জেটিতেও পুগাল এর পরিচিত একটি ছেলে, রাজার থাকার কথা| জাহাজ থেকে নেমে দেখি রঙের জাদুকরের ভেলকি এখানেও পিছু ছাড়েনি| ছাড়ার কথাও নয় অবশ্য| কিন্তু তাও, বারবার কিরকম অবাক বিস্ময় বোধ জাগছে মনে| এত রূপ যেন অবিশ্বাস্যই লাগছে কখনো কখনো| এখানে জলের নীল যেন আরো স্বচ্ছ, আরো উজ্জ্বল|
হোটেলে নিয়ে যাওয়ার পথেই রাজা আমাদের নিয়ে গেল ন্যাচারাল ব্রিজ দেখাতে| এটি আসলে একটি বিশালাকৃতির মৃত কোরাল, তোরণের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| জায়গাটি খুব শান্ত ও মনোরম| রোদ প্রখর হলেও একটু ছায়া দেখে বসে থাকতে যে কি ভালো লাগছে! জলে রঙের এমনই মোহ, চোখ ফেরাতেই ইচ্ছে যায়না| ঘন্টার পর ঘন্টা চোখের পলক না ফেলে তার রূপসুধা পান করা যায়| ঢেউ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলেও বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছি, অগত্যা জুতোর ভেতর জল ঢুকে ভিজে গেছে| ফিরে গিয়েই শুকোতে দিতে হবে|

     নীল আইল্যান্ডটি বিস্তৃতিতে খুবই স্বল্প পরিসর| দ্বীপের প্রধান রাস্তাটি সর্বসাকুল্যে ৮ কি.মি. লম্বা| বাইক ভাড়া পাওয়া যায় এখানে, ঘোরার জন্যে যা অত্যন্ত সুবিধাজনক| আমরা এখনি ঠিক করে ফেলেছি, এর পরের বার যখন এসব, নীলের জন্যে বরাদ্দ হবে অন্তত ২ দিন এবং পায়ে হেঁটে দ্বীপটা চষে বেড়াব যতটা পারি| এখানেও বাঙালি আধিপত্য এত বেশি যে আমাদের হোটেলের নামটাও (অমূল্য রেসিডেন্সি) বাংলায় লেখা| রাজা নিজে তামিল হলেও সারাদিন আমাদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলে গেল সাবলীল ভাবে| আমাদের হোটেলের বাসিন্দারাও দেখলাম সবাই বাঙালি| তবে শুধু আমরাই কোনো ট্যুর অপারেটরের সাথে আসিনি| তাই বেশ নিশ্চিন্তমনে ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজেদের মত করে| কোনো নিয়ম বা সময়ের বাঁধাধরা গন্ডিতে বাধ্য নই আমরা|

    
বিকেলে গেলাম লক্ষ্মণপুর বীচ| নীল আইল্যান্ড এর জায়গা গুলো রামায়নের চরিত্রের নামে নামাঙ্কিত| রামনগর, সীতাপুর, লক্ষ্মণপুর ও ভরতপুর| আমি ভেবেছিলাম এখানেও বিদেশী পর্যটকদের রমরমা দেখব, হ্যাভলকের মত, কিন্তু দেখলাম বাঙালিদেরই আধিপত্য| আমরা যখন পৌঁছই, বীচটি তখন নির্জন| অর্থাৎ, আবার একাত্ম হওয়ার সময়, আবার সমুদ্র, আকাশ, প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার সময়| সঙ্গীরা তো যথারীতি তার ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, আমি শুধু আমার একলা মন ভাগ করে নিই এই জল-বালি-আকাশের সাথেই|

    
আরো একবার সেই সূর্যাস্তের পালা| আবার সেই মায়াবী আলোয় জল আর আকাশের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার শুভক্ষণ এসে আপ্লুত করছে| এই সময় শুধু হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, নিজের থেকেও অনেক দুরে| সব মনখারাপ মিলিয়ে যায় ওই দিগন্ত রেখায়, যেখানে আকাশ হারিয়ে গেছে সমুদ্রের বুকে... নাকি সমুদ্র আকাশে?

অনেকখানি ভালোলাগা নিয়ে ফেরার পর ঠিক করলাম কাছাকাছি স্থানীয় বাজারে একটু ঘুরে দেখব| তা ঘুরতে এসে দেখি বাজার শুরু হওয়ার পর দু’ পা হাঁটলেই বাজার শেষ! কি আর করা, আবার আমরা হোটেল মুখো| বলতে ভুলে গেছি, লক্ষ্মনপুর বীচ থেকে ফেরার পথে একজনের কাছে তন্দুরি কাঁকড়া অর্ডার করে এসেছি, সে হোটেলেই পৌঁছে দেবে বলেছে| প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ এলো সেটা| খুলে দেখি সে পরিমানে প্রচুর| যদিও আমি কম করেই অর্ডার করেছিলাম, তাও যেটা দিয়েছে সেটা আমার একার জন্যে অনেক! খেতে কিন্তু দারুন| প্রায় এক ঘন্টা ধরে কাঁকড়ার দাঁড়া-টাঁড়া নিয়ে কসরত করে যুদ্ধে জয় লাভ করলাম| আজও তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে, কারণ কাল ভোরে উঠে আমরা সানরাইজ দেখতে যাব|

৫.২.২০১৭:               অন্ধকার থাকতে থাকতেই উঠে পড়েছি| কোনরকমে ঘুম চোখে জামাটা পাল্টে নিয়েই বেরোব সূর্যোদয় দেখতে| দিল্লীতে তো এই সুবর্ণ সুযোগ বা সময় কোনটাই হয়না| তাই এখানে এসে একটি সুযোগও হাতছাড়া করতে চাই না| তৈরী হয়ে রাজাকে ফোন করে ডাকতেই ও চলে এলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই| কাছেই বাড়ি ওর| যখন সীতাপুর বীচে পৌঁছলাম, তখনও বেশ অন্ধকার| আমরা ছাড়াও আরো দু-একজন এসেছে| আস্তে আস্তে আরো কয়েকজন এলো| এই সৈকতটিও বেশ ছোট| ধীরে ধীরে পূব আকাশ রাঙাতে শুরু করছে, কেটে যাচ্ছে আঁধারের অন্তরাল| আকাশে অল্প বিস্তর মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাই পুরো পরিবেশটাই হয়ে উঠেছে আরো নাটকীয়| আমরা যেন এই রঙ্গমঞ্চের দর্শক| কোনো এক অদৃশ্য পরিচালক সুনিপুণ দক্ষতার সাথে রচনা করছেন তাঁর নাটকের প্রথম দৃশ্য| সারাদিন নানাভাবে আরো কত কিছুই লেখা হয়ে যাবে!

     একটু একটু করে আলো যতই ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বময়, মনটা ততই কেমন যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠছে| এ জগতে যেন কোনো দু:খ থাকতে পারে না, কষ্ট থাকতে পারে না| সকলের সব মনখারাপ মুছিয়ে দিতে পারে, এ এমনই মায়াবী আলো| কিন্তু নাটকের নায়ক, অর্থাৎ সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না| তার আলোর ছটায় সবাই ধুয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি এখনো লুকোচুরি খেলছেন মেঘের আড়ালে থেকে| সবাই যখন প্রায় হতাশ হয়ে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছে, ঠিক তখনি, তক্ষুনি হলো সেই মিরাকল! একটুকরো মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন তিনি| সুর্যগ্রহণের পর রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে সূর্যের যে হীরের আংটির দ্যুতি ঠিকরে পড়ে, এও ঠিক সেই রকম| একখন্ড হীরক থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে সারা আকাশ জুড়ে| জল, মাটি, আকাশ – সবাই খেলছে তাদের প্রাত্যহিক হোলি, হলুদ, কমলা, লাল আবীর নিয়ে| এই মুহুর্তগুলোতে বেঁচে থাকার জন্যে বারবার আসা যায় এই পৃথিবীতে, বারবার ভুলে যাওয়া যায় সকল ক্লেশ|

     স্নান আর ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম| আজকেই পোর্ট ব্লেয়ার ফেরার জাহাজ ধরব আমরা| তবে তার আগে কিছুক্ষণ ভরতপুর বীচে সময় কাটাব| ভরতপুর বীচটা একেবারেই জেটির ধরেই| কাল জেটিতে নেমেই যে ম্যানগ্রোভগুলোকে জলে অর্ধ নিমজ্জিত দেখেছিলাম, আজ দেখলাম সেগুলো আজ অনেকটাই উন্মুক্ত, নিশ্চই ভাঁটা চলছে এখন|
অলসভাবে হেঁটে, ঘুরে, ছবি তুলে, সময় কাটালাম| কিছু টুকটাক কেনাকাটিও করলাম বাড়ির সবার জন্যে| জাহাজের সময় এগিয়ে আসছে| এই ছোট্ট দ্বীপটা এই অল্প সময়ের মধ্যে এমন মায়ায় বেঁধে ফেলেছে, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না| কিন্তু উপায় তো নেই| আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি ছাড়া আমার তো আর কিছুই দেওয়ার নেই তাকে| সে কিন্তু দু’হাত ভরে দিয়ে চলেছে| তার ঝাঁপিতে যত রং ছিল, সব সে যত্ন করে মাখিয়ে দিয়েছে আমার চোখে|

     আবার makruzz| এখানেও সেই হ্যাভলকে আলাপ হওয়া পরিবারটির সাথে দেখা হলো| নীলে এসে অনেক জায়গাতেই হয়েছে| আসলে দ্বীপটা অতি ছোট, এখানে দেখা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক হত| হয়ত আর কোনদিন এদের সাথে দেখাই হবে না, তবু এই ২-৩ দিনের পরিচয়টাও কতদিন মনে থেকে যাবে| এও এক ধরণের আত্মীয়তা| আর ভ্রমণই পারে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষদের এই অদৃশ্য আত্মীয়তার সুত্রে বাঁধতে|

       পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে প্রায় আড়াইটে বেজে গেল| পুগাল অপেক্ষা করছিল জেটিতে| প্যাকড লাঞ্চ কিনে নিয়ে আমরা রওনা হলাম চিড়িয়া টাপুর দিকে| এখানে সূর্যাস্ত নাকি দেখার মত একটা জিনিস বলে শুনেছি| সানসেট পয়েন্টের থেকে একটু দুরে একটি পার্ক তৈরী করা আছে, সেই পার্কের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট ট্রেক রুট আছে মুন্ডা পাহাড়ের দিকে| স্থানীয় লোকজনের বেশ ভিড় দেখলাম এখানে, আজ রবিবার বলে বোধহয়| খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে ওই ট্রেক রুট ধরে হাঁটা শুরু করলাম| ঠিক কোন জায়গাটা মুন্ডা পয়েন্ট, সেটা আমি নিশ্চিত বলতে পারব না| তবে এক জায়গায় এসে বেশ খোলা একটা প্রান্তর, পাশে একটি সুইসাইড পয়েন্ট আছে (আজ অবধি আমি বোধয় এমন কোনো যায়গায় বেড়াতে যাইনি যেখানে এই নামে কোনো জায়গা নেই! কে আসে এত সুন্দর জায়গায় সুইসাইড করতে? এই সৌন্দর্যের মধ্যে কি মৃত্যুর কথা মনে আসে কারো?), সম্ভবতঃ সেটাই মুন্ডা পয়েন্ট| সেখানে এসেই বেশির ভাগ লোকজন থেমে যাচ্ছে, তবে আমরা এগোলাম আরো| আরো এক-দেড় কিলোমিটার এগিয়ে একটি লাইট হাউস আছে, তার পেছনে সমুদ্র দেখা যায়, এবং একজনের মুখে শুনলাম এটি দক্ষিণ আন্দামানের দক্ষিণতম প্রান্ত| জায়গাটি প্রকৃত অর্থেই খুব সুন্দর| এতটা হেঁটে আসা সার্থক মনে হয় এখানে এসে|

    
নেমে এসে গাড়িতেই গেলাম সানসেট পয়েন্টের দিকে| রাস্তার পাশে খাঁড়ির মত জল, উল্টো দিকে পাহাড়ের কোলেই সূর্য অস্ত যায় এখানে| জলের মধ্যে ইতস্ততঃ কয়েকটা গাছের গুঁড়ি, কয়েকটা পাথর এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে| আর তাতে জায়গাটার সৌন্দর্য একলাফে বেড়ে গেছে অনেকটা| সূর্য যখন আস্তে আস্তে পাহাড়ের কোলে নামল, জলের মধ্যে তখন যেন কেউ ছড়িয়ে দিল অসংখ্য সোনার কুঁচি| দুরে একটা দুটো উদাসী নৌকো ভেসে চলেছে| সূর্য যতই নেমে আসছে, জলে ততই লাগে সোহাগের ছোঁয়া| সূর্যোদয় মনে প্রশান্তির ছাপ রেখে গেছিল বলেছিলাম, কিন্তু সূর্যাস্ত প্রতিবারই বয়ে আনে মনখারাপের বার্তা| যে হাত একদিন হাতের মুঠো ছেড়ে দিয়েছিল, তার স্পর্শের স্বাদ নতুন করে আচ্ছন্ন করে তোলে| শেষ বেলার পড়ন্ত আলোটা কেমন যেন বিবশ করে তোলে মনকে, যা নেই তাই পাওয়ার আশায়|

৬.২.২০১৭:        ইংরাজি ক্যালেন্ডার মতে এই দিনলিপি নতুন তারিখে লিখছি বটে, তবে বাংলা মতে এখনো নতুন দিনের শুরু হয়নি| রাত সবে আড়াইটে| এই মাঝরাতে উঠে কি করছি তাই ভাবছেন? আজ আমরা উত্তর আন্দামানের দিগলিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব| দুরত্ব প্রায় ৩৬০ কি.মি., সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টা| তার ওপর এই রাস্তায় পড়ে জারোয়া রিজার্ভ, যেটি পেরোতে কনভয়ের নির্ধারিত সময় মেনেই যেতে হবে| সারা দিনে ৪ বার কনভয় যায়, তিন ঘন্টা অন্তর| অত দুরের রাস্তা, তাই সকাল ৬ টার প্রথম কনভয় না ধরলে বেজায় মুশকিলে পড়তে হয়| মুশকিল অবশ্য তেমন নয়, শুধু দিগলিপুর পর্যন্ত পৌঁছনো যায়না এক দিনে, মাঝখানে রঙ্গত বা মায়াবান্দরে রাত্রিবাস করে পরদিন দিগলিপুর যাওয়া যায়| কিন্তু এতে একদিন সময় নষ্ট| তাই আজ আমরা সাড়ে তিনটের সময়ে বেরিয়ে কনভয়ের লাইনে দাঁড়াব| যথাসময় তৈরী হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে দেখি পুগালও এসে গেছে| মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠা, তার ওপর গাড়িতে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া| আমাকে আর পায় কে? গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম| ঘুম ভাঙ্গলো ৫টা নাগাদ, গাড়ি যখন জিরকাটাং চেকপোস্ট পৌঁছেছে| এখান থেকেই কনভয় ছাড়ে| সব গাড়ির নম্বর টুকে রেখে এক এক করে ছাড়া হয়| জারোয়া রিজার্ভের মধ্যে গাড়ি গুলোকে কনভয় মেনেই যেতে হবে, ওভার টেক করা যাবে না| এবং স্পীড এর সীমাও ঘন্টায় ৪০ কি.মি.|

     লাইনে আমাদের গাড়ি ৩ নম্বরে| ৬ টার মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ টা গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল| যথারীতি যাত্রীদের ৯৫ শতাংশই বাঙালী| এবং তাদের আদিকাংশের মধ্যেই জারোয়া দেখার অত্যন্ত দৃষ্টিকটু অশ্লীল উত্সাহ| যেন তারা মানুষ নয়, ভিনগ্রহ থেকে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে চলে আসা কিছু আজব জন্তু| প্রায় দেড় ঘন্টা পর রিজার্ভ থেকে বেরিয়ে যখন মিডল স্ট্রেট পৌঁছলাম, তখন তো বেশির ভাগ লোকজন প্রচন্ড হতাশ, জারোয়া দেখতে না পাওয়ার জন্যে| এবং তাতে নাকি তাদের এই জার্নিটাই মাটি! অথচ, রিজার্ভের ভেতরটা কি সুন্দর! দুধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, জঙ্গল কোথাও ঘন, কোথাও বা হালকা হয়ে এসেছে| ঘন জায়গাগুলোতে গাছের এতটাই ভিড় করে আছে যে সূর্যের আলো প্রায় প্রবেশ করতে পারে না| আর যেখানে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, সেখানে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মিছটা এসে রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে আলতো আদরে| জঙ্গলের গাছ গুলোতে, তাদের নতুন পাতায় লেগেছে আসন্ন বসন্তের প্রেমের রং, ঠিক যেন নববধুর সিঁথির সিঁদুরে লাজ| প্রকৃতি তো মুক্ত হস্তে আমাদের জন্যে চারদিকে বিছিয়ে রেখেছে তার রূপের সম্ভার| শুধু দেখার চোখটাই দেয়নি সবাইকে| তাই বুঝি কেউ আড়ম্বর খোঁজে, বাহ্যিক বাহুল্যতায়, নকল সাজসজ্জায় রূপ খোঁজে| আর কেউ কেউ খুশি হয়ে বরণ করে নেয় নিরাড়ম্বর প্রেমটুকু, সেটাই হয়ে ওঠে তার অন্তরের ধন| আর এই জারোয়ারা, তারা তো আমাদের মতই মানুষ| তাদের দেখতে না পেলে আন্দামান আসাই বৃথা – এ তো সেই মানুষ জাতিকে অপমান করার সমতুল্য, মনুষ্যত্বকে অসম্মান করার মাফিক| হোক না তাদের গায়ের রং নিকষ কালো, হোক না তাদের মাথার চুল ছোট ছোট ও কোঁকরানো, তবু তারা তো পারে তাদের নিজস্বতা বজায় রাখতে| আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা সেটা পেরেছি কই? এখন যদিও তারাও অনেকটাই বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে, অতটা শত্রুভাব পোষণ করে না ঝকমকে জামা কাপড় পরা লোকেদের প্রতি| কিন্তু নিকোবারিজরা এখনো সভ্য জগতের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি| তারা এখনো তাদের মত করে বাঁচে, তাদের নিজস্বতাকে বাঁচিয়ে রেখে বাঁচে|

    
মিডল স্ট্রেট পেরোতে হবে বোটে| এবং যত গাড়ি, বাস, যা কিছু বাহন ওপারে যাবে, সবই বোটে করেই পেরোবে| পেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে চাপা| এরপর আর একবার বোটে চড়তে হয় কদমতলায়| এই উত্তর আন্দামানের পথে সব জায়গা গুলোর নাম একেবারেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার নামের মত – কদমতলা, দুর্গাপুর, শিবপুর ইত্যাদি| শুনলাম এদিকে বাঙালিদেরই বসবাস| মাঝে মাঝে দু-একটি চেকপোস্ট, সেখানে নিয়মমাফিক কাজ সেরে আবার চলা| রঙ্গত পৌঁছে বেশ কয়েকটা বীচ ঘুরে নিলাম আবার|


আমকুঞ্জ ও মরিসডেরা – ২টো বীচ| এরপর বেতাপুরে একটি ম্যানগ্রোভ ওয়াক| দুধারে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরী করা আছে রাস্তা, মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্যে ছাউনি করা, তাদের আবার নামকরণও করা আছে, আন্দামানের বিভিন্ন পাখিদের নামে| ম্যানগ্রোভেরও কত রকমফের, আর কতই বা তাদের নামের বাহার - হাতিকান, কামান গোলা ইত্যাদি| এই হাঁটা রাস্তা নিয়ে যায় ধানী নাল্লা সৈকতে| এখানে একটি টার্টল হ্যাচারী আছে, কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড বা অন্য কেউ না থাকায় এদিন আর সেখানে কচ্ছপ দেখা হলো না| অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, তাই বেশি সময় ব্যয় না করে আবার গিয়ে বসলাম গাড়িতে| আবার চলা শুরু| বিকেল ৪টে নাগাদ আমরা দিগলিপুর পৌঁছলাম| তবে আমরা থাকব দিগলিপুর শহর থেকে আরো ২০ কি.মি. দুরে কালিপুরে| এখানে থাকার জায়গা বলতে ২ টি| একটি সরকারী গেস্ট হাউস, আর একটি প্রাইভেট| আমাদের আগে থেকে বুকিং ছিল না কোথাওই| প্রথমে প্রাইভেট রিসর্টটিতেই ঢুকলাম| বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরী রিসর্টটি| খুব পরিপাটি বাগান রয়েছে এখানে, এবং পক্ষীপ্রেমীদের জন্যে জায়গাটি রীতিমত স্বর্গ|


এসেই বুঝলাম এখানের জন্যে মাত্র একটি রাত বরাদ্দ রাখা খুব বোকামি হয়েছে| কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই| এখানে কটেজ গুলোও খুব সুন্দর, ছিমছাম, সাজানো| একটি অস্ট্রালিয়ান দম্পতির সাথে আলাপ হলো, এখানে আমাদের প্রতিবেশী| ভদ্রলোক কাঁধে একটা বিশাল লম্বা লেন্স সমেত ক্যামেরা আর হাতে একটা “বার্ডস ইন আন্দামান” বই নিয়ে পাখি খুঁজে আর ছবি তুলে চলেছেন| কোনো একটা পাখি দেখলেই বই খুলে ছবির সাথে মিলিয়ে বার করছেন তার নাম| এদের জীবনটা কি ঈর্ষনীয় লাগে মাঝে মাঝে| কতভাবে জীবনটাকে উপভোগ করা যায়, এরা জানে এবং সেই উপায়ও তাদের আছে| আমাদের দেশের লোকেদের হয় ইচ্ছেটাই নেই, ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য নেই অনেকের, আবার দুটি যাদের আছে তাদের অনেকেরই আবার উপায় নেই| কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ছুটি পাওয়া যায় না এখানে, অথচ বিদেশে বহু লোক আছে যারা ৬ মাস কাজ করেন এবং বাকি ৬ মাস পৃথিবী ঘুরে কাটান|

     যাই হোক, যা নেই সেই আলোচনা এখন মুলতুবি থাক| আপাতত যা আছে, সেখানে মনোনিবেশ করি| রিসর্টটিতে অসংখ্য গাছ্পালা, এবং আগেই বলেছি নাম জানা-না জানা অসংখ্য পাখি| মালিক ভদ্রলোকটিও খুব আলাপী| অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত বাগানে হেঁটেই কাটিয়ে দিলাম| রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর যাব কচ্ছপের ডিম পাড়া (টার্টল নেস্টিং) দেখতে, কালীপুর বীচে| অবশ্য দেখতে পাওয়াটা পুরোটাই ভাগ্যের হাতে| রোজ তারা আসে না| তাদের আসা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর| জোয়ারের সময় তারা আসবে, আবার খুব তীব্র জোয়ারে নয়| চাঁদের আলো বেশি তীব্র হলে আসবেন না ওনারা| আহা, কচ্ছপ বলে কি ওদের কোনো প্রাইভেসী নেই নাকি? রাত্রে ১২ টা নাগাদ গেলাম বটে, তবে আমাদের পোড়া কপালে শিকে ছিঁড়ল না| এখন নাকি ভাঁটা এসে গেছে, তার ওপর চাঁদও এখন বেশ জোরালো, অর্থাৎ, তারা এলেন না আজ| কি আর করা, ভগ্ন হৃদয়ের দু:খ নরম বিছানাতেই এলিয়ে দিলাম| 

৭.২.২০১৭:                আজ সকালে বেরোনোর খুব বেশি তাড়া নেই| এখান থেকে আজ চলে যাব যদিও, কিন্তু মাঝে রঙ্গতে রাত কাটাব, তাই একদিনে অতটা বেশি দুরত্ব অতিক্রম করার টেনশন নেই| এদিকে কাল টার্টল নেস্টিং দেখতে না পাওয়ার আফশোষ এখনো যায়নি| যাওয়ার পথে রস এন্ড স্মিথ আইল্যান্ড দেখে সে দু:খ অবশ্য কিছুটা ঘুচলো| এই যমজ দ্বীপ মাঝে একটি বালির চর দিয়ে জোড়া| জোয়ারের সময়ে সেই চর জলের নিচে ডুবে যায়, তখন দেখে মনে হবে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা দ্বীপ এগুলি| ভাঁটার সময় জল নেমে গেলেই দেখা যায় এদের মাঝের যোগসূত্র খানা| উত্তর আন্দামানে খুব বেশি পর্যটক আসেন না, তাই ভিড় নেই বেশি| দিগলিপুর থেকে নৌকা করে আসতে হয় এখানে| এখান থেকে ফিরে এসে আমরা রঙ্গতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম| পথে মায়াবান্দরে কারমাটাং সৈকতে কাটালাম বেশ অনেকটা সময়| বেশ লম্বা একটি সৈকত| এবং আমরা ছাড়া আর কেউই নেই সেখানে| বেশ প্রাইভেট বীচে সময় কাটাচ্ছি এরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে|
যেমন ইচ্ছে, যেদিকে ইচ্ছে হাঁটছি, ছবি তুলছি| কেউ দেখারও নেই| এখান থেকে বেরোনোর সময় একজনের কাছে একটি আশার কথা শুনলাম| ধানী নাল্লা বীচ, যেটা আমরা কাল যাওয়ার পথে দেখেছি, সেখানে নাকি এখন কচ্ছপেরা ডিম পাড়তে আসছে| সুতরাং আমরা রাত্রে ওখানে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি|  কাল থেকে হতাশ হয়ে পড়া উদ্যমে আবার একটা নতুন জোর পাওয়া গেল| অতএব আবার এগিয়ে চললাম আমরা| প্রথমে ঠিক ছিল আমরা রঙ্গতে গিয়ে থাকব, কিন্তু ধানী নাল্লা আসতে গেলে রঙ্গত থেকে সেটা কিছুটা দুরে হবে| তাই কাছে যে সরকারী গেস্ট হাউস আছে, সেখানে গেলাম| ফাঁকাও পাওয়া গেল ভাগ্যক্রমে| এবার আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা|

     রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর গেলাম| আবার সেই ম্যানগ্রোভ ওয়াকের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম সৈকতে| যে হ্যাচারীটা কাল দেখেছিলাম, তার পাশেই সিকিউরিটি গার্ডের থাকার জন্যে একটি একচালা ঘর রয়েছে| ডাকতেই দুজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন| বেশ সহৃদয় ওনারা| এখানেও আজ কচ্ছপদের আসার সম্ভাবনা খুব কম| কারণ ওই একই, পূর্নিমা আসন্ন, তাই চাঁদের আলো বেশ প্রকট| আর এত আলোতে তারা ডিম পাড়তে আসে না নাকি| তবে আমাদের হ্যাচারী দেখাতে নিয়ে গেলেন টর্চ নিয়ে| আর গিয়েই দেখি কি কান্ড! এক রাশ বাচ্চা কচ্ছপ, সদ্য ডিম ফুটে বেরিয়েছে ওরা, হ্যাচারির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে| কচ্ছপেরা যখন সমুদ্র তীরে বালিতে ডিম পেড়ে রেখে সমুদ্রে ফিরে যায়, সেই ডিম সংগ্রহ করে এই হ্যাচারিতে এনে বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়| একটি একটি গর্তে কত গুলো ডিম কবে রাখা হয়েছে, সেসব লিখে রাখা হয়| মোটামুটি ৪৫ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে| তারপর সেগুলো সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসা হয়| আমাদের প্রতি ভাগ্যদেবী কিছুটা হলেও সদয় হয়েছেন, আজই একটি হ্যাচ থেকে বাচ্চা বেরোনোর দিন| ওই দুই ভদ্রলোক মিলে একটি বালতিতে তুলে রাখলেন এক এক করে বাচ্চাগুলো| সংখ্যায় মোট ৮৬ টা তারা| তারপর সবাই মিলে গেলাম তাদের সমুদ্রে ছাড়তে| বেশ মজার অভিজ্ঞতা| ছবি তোলার জন্যে আলো ফেললেই তারা জলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসছে আমাদের দিকে| তারপর আলো নেভালে আবার জলের শব্দে মুখ ঘোরাচ্ছে|

     আরো কিছুক্ষণ আশায় আশায় ঘুরলাম বীচে, যদি ভুল করেও একটা চলে আসে আজ! কিন্তু না, সেই অসম্ভব আর সম্ভব হলো না| এ তো আর বলিউড সিনেমা নয়, আর আমিও কোনো নায়িকা নই, যে সব আনহোনি কো হোনি করে দিতে পারব! চাঁদের আলোয় ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতাও বেশ অনেকদিন মনে থাকবে আমার| চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু কিছু পোকা মাকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে| এতক্ষণে চাঁদের আলোতে চোখও সয়ে গেছে, আলাদা করে আলো লাগছে না পথ দেখতে| সব মিলিয়ে নেস্টিং না দেখতে পাওয়ার দু:খ এখন আর একেবারেই হচ্ছে না দেখলাম|

৮.২.২০১৭:       বেড়ানোর শেষের মুখে এসে বাড়ির জন্যে একটু হলেও মনখারাপ করে| হয়ত এই বাড়ির প্রতি টানটা আছে বলেই প্রতিবার ঘর ছাড়ার নেশাটা এত মধুর হয়| সবকিছুর শেষে ঘরে ফেরার আশ্বাসটা যেন নোঙ্গর দেয় একটা, আর তাতেই ফের ভেসে যাওয়ার সাহস যোগায় মনে| ৯ দিনের বেড়ানোর পর ঘরে ফেরার ইচ্ছেটা একটু একটু করে মনখারাপ করে দিচ্ছে আমাদেরও| তবু চলা তো থামে না, থামালে চলে না| সুতরাং, আবার আজ মাঝরাত থেকে উঠে, ধরাচূড়া পরে আমরা ভোর ৪ টের মধ্যে তৈরী| আজ আমরা এখান থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরব, পথে বারাটাং আইল্যান্ড ঘুরে| আবার ফিরতি কনভয় ধরতে হবে বলে তাড়াতাড়ি বেরোনো|

এই উত্তর আন্দামানে এসে একটা জিনিস খুব ভালো লাগল আমার| খুব ছোট জনপদেও শিক্ষাকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে| বাংলা মাধ্যমের স্কুলও আছে দেখলাম| কদমতলা পৌঁছে দেখি কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশ| কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, তাই বোটও ছাড়ছে না| বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, যখন সূর্যের আলো কুয়াশার সঙ্গে তরবারি খেলায় জয়লাভ করলো, আমাদের বোটও নোঙ্গর তুলল|

বারাটাং-এ একটি মাড ভলকানো আছে| এটি সম্ভবতঃ ভারতের একমাত্র মাড ভলকানো| মাটির ভেতর থেকে কোনো এক বিক্রিয়ায় ক্রমাগত কাদা নি:সৃত হয়ে চলেছে লাভার মত| ওখান থেকে এসে জলখাবারের পর্বটা মিটিয়ে নিলাম| তারপর আবার নৌকো করে গেলাম লাইম স্টোন কেভ দেখতে| এই বারাটাং-এ অনেক পর্যটক আসেন পোর্ট ব্লেয়ার থেকে| যারা নর্থ আন্দামান অবধি যায় না, তারা এখান পর্যন্ত এসে এই মাড ভলকানো আর লাইম স্টোন কেভ দেখে আবার ফিরে যান পরের কনভয়ে| লাইম স্টোন কেভ যাওয়ার পথটি ভারী মনোরম| ম্যানগ্রোভের মধ্যে দিয়ে যাওয়া| তারপর বেশ কিছুটা হেঁটে পৌঁছনো হয় কেভে|
স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের অপূর্ব কারুকার্য এখানে| এখানেও আমার সেই বিভিন্ন পরিচিত আকৃতি খোঁজার খেলা চলল কিছুক্ষণ, কোনটা পদ্মফুল, আবার কোনটা হাতির মাথা| যদিও গাইড বেশিরভাগই কোন দেব-দেবীর আকৃতি দিয়ে বর্ণনা করে, কিন্তু নিজের মত করে নিজের মনের ভাবনাকে ডানা মেলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তো আমার নিজের হাতেই, থুড়ি, নিজের চোখেই|

     ফিরে এসে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা পরবর্তী কনভয়ের জন্যে| পুগাল গাড়ি লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সময়মত| নিশ্চিন্ত মনে ছাউনিতে বসে বিশ্রাম করতে করতে, এবং বেশিরভাগ যাত্রীদের মুখে অত্যন্ত অশোভনীয়তার সাথে জারোয়া না দেখতে পাওয়ার আফসোস শুনতে শুনতে সময়টা কেটে গেল| কেউ কেউ তো আবার পথে যাকেই দেখেছে, তাদের গাত্রবর্ণের গাঢ়ত্বের সঙ্গে তাদের জারোয়া হওয়া বা না হওয়ার সম্ভাবনা যাচাই করতে বেশ মাথা ঘামাচ্ছে দেখলাম| সৌভাগ্যবশত: বিরক্তি চরম সীমায় পৌঁছনোর আগেই কনভয়ের টাইম হল|

     জারোয়া রিজার্ভের রাস্তাটা এই ভরদুপুরেও অত্যন্ত মনোরম রয়েছে| গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলোর লুকোচুরি খেলা এখনো অব্যাহত রয়েছে, যাওয়ার দিন যেমন দেখেছিলাম| নতুন পাতাগুলোতে বসন্তের রং কি আজ আর একটু বেশি করে লেগেছে? গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে মনটা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে| পেট্রল-ডিজেলের গন্ধে অভ্যস্ত নাকে এই গন্ধই যেন সঞ্জীবনী সুধার মত কাজ করে|

     ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল| পেটে তখন ছুঁচোদের ডন-বৈঠক চলছে| হোটেলে ফিরে কিছু খাবার পেটে দিতে তবে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম| সন্ধ্যেবেলা আজ আর বিশেষ কিছু করার নেই, অত:পর বিছানার নরম গদিতেই সঁপে দিলাম নিজেকে|

৯.২.২০১৭:        আজ আমাদের আন্দামান ভ্রমণের শেষ পর্ব| পোর্ট ব্লেয়ারের স্থানীয় জায়গা গুলো কিছু কিছু ঘুরব আজ| সকালে প্রথমেই গেলাম চ্যাথাম শ মিল|
১৮৮৩ সালে স্থাপিত এই মিল আজ রীতিমত ট্যুরিস্ট আট্রাকশন| গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ কেটে তাকে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হয়| আন্দামানের বিখ্যাত পাদাউক কাঠের জন্যে এই কারখানায় একটি সম্পূর্ণ আলাদা সেকশন আছে| পুরো কারখানাটা ঘুরে দেখতে মন্দ লাগে না| একটি প্রদর্শনীও আছে এখানে, রীতিমত নজরকাড়া বেশ কিছু কাজ দেখা যায় সেখানে| এখান থেকে কাছেই চ্যাথাম হোয়ার্ফ জেটি| এই জেটি থেকে বোটে করে আমরা যাব বাম্বুফ্ল্যাট| মাউন্ট হ্যারিয়েট, আন্দামানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থান| প্রথম স্থানাধিকারী স্যাডেল পিক রয়েছে দিগলিপুরে| সেখানেও ট্রেক হয়, কিন্তু বেশ সময়সাপেক্ষ, তাই আমরা করতে পারিনি| মাউন্ট হ্যারিয়েটে একটি ন্যাশনাল পার্ক আছে আন্দামান প্রশাসনের| জায়গাটা অত্যন্ত শান্ত, খুব বেশি লোকজনও নেই দেখলাম| জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় কত রকমের পাখির ডাক-ই যে শোনা যায়! ভেতরে একটি রেস্ট হাউসও আছে দেখলাম| এত লোভনীয় যে অনায়াসে সেটা যে কারোর bucket list-এ চলে আসবে|
দুটি ভিউ পয়েন্ট তৈরী করা আছে ভেতরে, যেখান থেকে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন দ্বীপ দেখা যায়| কোনো দিকে নীল, কোনো দিকে নর্থ বে| আমরা ভারতীয় ২০ টাকার নোটে নর্থ বে লাইট হাউসের যে ছবিটা দেখি, সেটি এখান থেকে তোলা| কালাপাত্থর ট্রেক বলে একটি ট্রেক রুট আছে এর ভেতর দিয়ে| সেই সুযোগ কি ছাড়া যায় নাকি? প্রায় ২ কি.মি. লম্বা রাস্তা| যদিও কালাপাত্থরের বিশেষত্বটা যে ঠিক কি, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি সেদিন| পরে ফিরে এসে উইকিপেডিয়াতে পড়েছি, এখান থেকে বন্দীদের গিরিখাতে ঠেলে মেরে ফেলা হত| পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখস শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া অন্য আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না| পক্ষীপ্রেমীদের এবং বিশাল বিশাল লেন্স সহ DSLR-ধারীদের জন্যে এই জায়গা রীতিমত স্বর্গ|

    



ওখান থেকে ফিরে এসে মেরিন মিউজিয়াম আর অন্থ্রোপোলজিকাল মিউজিয়াম দেখা হল| দুটি অত্যন্ত আকর্ষনীয় সম্ভারে সমৃদ্ধ| মেরিন মিউজিয়ামে বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক প্রাণীদের আলাদা আলাদা কক্ষে প্রদর্শন করা রয়েছে| এর মধ্যে শঙ্খ ও প্রবালের সংগ্রহ আমার খুব  আকর্ষনীয় লাগলো| অন্থ্রোপোলজিকাল মিউজিয়ামে আন্দামানের আদিবাসী, যেমন ওংগে, গ্রেট অন্দামানিজ, সেন্টিনেলিজ এবং জারোয়াদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ব্যবহার্য সামগ্রী ইত্যাদির নমুনা দেখা যায়|

    
ফেরার পথে পুগাল আমাদের নিয়ে গেল জগার’স পার্ক| এখান থেকে এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়| জায়গাটা অপ্রত্যাশিত ভাবে সুন্দর| ঠিক বিকেল ফুরিয়ে আসার মুখে, আকাশে হালকা মেঘের মায়াজাল ছিঁড়ে সূর্যের শেষ রশ্মিচ্ছটা ঠিকরে পড়ছে আর সারা আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অলীক রং| এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয়ে এলো| আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপর ছেড়ে চলে যাব আমরা এই শহর, এই দ্বীপ| এখানে বিভিন্ন আইল্যান্ডে দেখেছি বোর্ড টাঙানো আছে – “don’t take anything except memories”. অন্য কিছু নিয়ে যাওয়ার তো সুযোগই নেই আমার কাছে, স্মৃতিতেই তো ভরে গেছে প্রাণ| মনের একটা আলাদা প্রকোষ্ঠে যত্ন করে জমানো আছে সব|

১০.২.২০১৭:              অবশেষে শেষের দিন সমাগত| বাড়ির জন্যে টান অনুভব করছিলাম ২ দিন আগে, অথচ আজই আবার এই জায়গাটার জন্যে মনটা ভারি হয়ে উঠছে| এই কদিনে জায়গাটা দু’হাত ভরে দিয়েছে শুধু| কত রকমের অভিজ্ঞতা যে হয়েছে এই কদিনে| সমুদ্রের নিচে ডুবেছি, প্রচুর হেঁটেছি, এমনকি ট্রেকও করেছি এখানে এসে| কত রকমের রং যে দেখেছি তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই জানি, তাই চেষ্টাও করছি না| হেসেছি, কেঁদেছি, নস্টালজিয়ায় ভুগেছি, এক কথায় জীবনটাকে প্রানভরে বেঁচেছি এই কদিনে| অনেকগুলো মুহূর্ত বন্দী করে নিয়েছি আমার মুঠোফোনে, কিন্তু চোখ যা দেখেছে তার কাছে সেগুলো অতিশয় নগন্য| আকাশ এবং সমুদ্রকে মিলেমিশে একাকার করে দেওয়া এমন রঙের খেলা আর কি কোথাও হয়? আর কি কোথাও দিগন্তকে এভাবে ধুয়ে দিতে পারে অস্তরাগের ছোঁয়া? মানুষ কি এত সরল হয় আর কোথাও? এই আন্দামানই প্রথম জায়গা যেখানে এসে, সেখানে থাকাকালীনই আমি দ্বিতীয়বার আসার প্ল্যান করে নিয়ে ফিরছি|

     আকাশ থেকে যতক্ষণ সম্ভব দেখা যায়, চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি এই দ্বীপরাজিকে, মেখে নিচ্ছি তার সবুজ, জড়িয়ে নিচ্ছি তার নীল| ভালো থেকো আন্দামান, উজাড় করে দাও তোমার সব রূপ, আরো আরো মুগ্ধ কর তোমার কাছে ছুটে আসা সকল পর্যটকদের| তারা যে বড়ই পিপাসার্ত, তোমার সৌন্দর্য্যের অমৃতসুধা পান করিও তাদের|


এই লেখা সেই অর্থে ঠিক ভ্রমণকাহিনী নয়| এতে আন্দামানের ইতিহাস বা ভূগোল সম্পর্কে প্রায় কোনো তথ্যই নেই| জায়গাগুলোর বিবরণে আমার আবেগই বোধহয় বেশি প্রকাশ পেয়েছে| আমি তো আসলে ভ্রমণকাহিনীর লেখক নই| বা বলা ভালো, লেখকই নই আমি| এটা আমার চোখে দেখা আন্দামান, আমার ভাবনার রঙ্গে রাঙানো আন্দামান| আমার কল্পনার সাজেই সাজিয়েছি তাকে| আমার স্বপ্নই তার অলংকার, আমার অনুভবই তার কপালের আল্পনা| আমার ভালবাসার বসনে সে সেজে উঠেছে নববধুর বেশে| বড় যত্নে লালন করব তাকে, বহুদিন.... বহু বছর...

14 comments:

  1. boro bhalo likhechho Parna - ki bolbo... kono plan na kore-o je eto sundor ghora jaay, etai aschorjo lagchhe - kono kichhu i baad dao ni dekhchhi tomra - khub sundor tour ta hoyechhe, ekebare perfect... aar tomar lekha ta eto i sundor hoyechhe je tomar sange sange ami o ghurlam aar mon bhore gelo - jotodin jete na parchhi, totodin tomar smriti tei makha hoye thak amar Andaman er swapno... <3

    ReplyDelete
    Replies
    1. han go... sobai prochur bhoy dekhiyechilo... booking na kore jachchi, bhoyonkor asubidhey porbo etc etc... kintu sotyi-i kono samosyai hoy ni. okhane lokjon ato cooperative. amra port blair er hotel tay 3 te spell-e thekechi, pay korechi akebare sesh dine. hotel malik nijei bollo aage pay korte habe na, apnara to kadin pore abar asben-i !! baro valo jayga ta go... amra ar akbar jabo... aksathe jaoyar plan kora jete pare :)

      Delete
  2. Thanks Parna ei lekhatar jonno, mane holo ardhek ta tomader chokh/camera die dekha hoye gelo baki jadi kono din kapale lekha thake.....

    ReplyDelete
  3. Script ta pore mone holo ami nije Andaman chole gechi r jabo . Thanx to Tony .

    ReplyDelete
  4. And many thanks to parna. Amar Jibi future e jai ok Tamil cheleta jar name pogal er phone number ta amader send karo . Again thanx all of u .

    ReplyDelete
  5. valo laglo apnar lekha ta pore, darun. ami Avishek er onek diner fb friend.

    ReplyDelete
  6. Lekhata Khub bhalo laglo. Sathe chhobigulo boro sundor.

    ReplyDelete
    Replies
    1. tumi amar chhobir proshongsa korchho?? amar to ebar ar mati te paa porbe na !!! thank u so much...

      Delete